এজিএম পার্টির জিম্মিদশা থেকে বিনিয়োগকারীদের মুক্তি মিলবে কবে?

ডামি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে

খােন্দকার জিল্লুর রহমান :
‘এজিএম পার্টি’ পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত ও পরিচিত শব্দ। অদৃশ্য এ শক্তির হাতে কখনও বিনিয়োগকারী আর কখনও জিম্মি কেম্পানির পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। বহুল আলোচিত এ চক্রের কারণে তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) কথা বলার অধিকার এবং বছর শেষে ন্যায্য ডিভিডেন্ড বঞ্চিত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু কোনোভাবেই এ চক্রকে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং আলোচনায় এলেও রহস্যজনক কারণে সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে এ চক্রের নেপথ্যের নায়করা। এজিএম পার্টির কর্মকান্ড আর বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরও নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয় বলেও তথ্য পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে এজিএম পার্টির কাছে জিম্মি থাকা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এজিএম পার্টির তৎপরতার টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। কোভিডের কারনে ২০১৯এর মাঝামাঝি হতে একত্রে লোকসমাগম নিষিদ্ধ থাকার কারনে কোম্পানিগুলি ভার্চুয়ালি এজিএম করলেও সাধারন বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত বঞ্চিতই ছিলেন, কিন্তু এজিএম পার্টি সুযোগ সন্ধানী কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সাথে আতাত করে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেয়। কোভিড চলেযাওয়ার পর এ্যাকচুয়ালি এজিএম করার সুবিধা থাকলেও নিজেদের দুর্বলতা এবং জবাবদিহিতা এড়িয়ে যাবার জন্য এজিএম পার্টির গোপন আতাতের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি এজিএম করে যাচ্ছে, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অদৃশ্য কারনে লোকবল সঙ্কটের কারন দেখিয়ে নির্চুপ রয়েছে। বাজারের স্বচ্ছতা, বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য অধিকার ও কোম্পানিগুলোর স্বার্থেই এ চক্রকে চিহ্নিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। কিন্তু এজিএম পার্টির তৎপরতার বিষয়ে দায়িত্বশীলদের জানা থাকলেও রহস্যজনক কারণে এ অপশক্তিকে দমন করা যাচ্ছে না। এখনও এজিএম পার্টিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সম্প্রতি এজিএম পার্টির তৎপরতার কারণে দুএকটি কোম্পানি ঢাকার বাইরে অনেকটা গোপনে এজিএম করেছে। ফলে ওই কোম্পানির এজিএমে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অংশ নিতে পারেননি। অন্যদিকে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এজিএমে এজিএম পার্টির ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের হাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নাজেহাল হয়েছেন। সংবাদকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর ধরে লিখে আসতেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই এই অশুভ শক্তির তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। ডিভিডেন্ড মৌসুম ঘিরে সংঘবদ্ধ এ চক্রের তৎপরতার কারণে আবারও আমাদের এ বিষয়ে নজর দিতে হচ্ছে।
কিন্তু আর কত দিন সাধারন বিনিয়োগকারীদের জিম্মি থাকতে হবে?
পুঁজিবাজারে কোম্পানির মালিকপক্ষ ও বিনিয়োগকারীদের মিলনমেলা হচ্ছে এজিএম। এতে কোম্পানির পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীর জন্য পূর্বঘোষিত ডিভিডেন্ড অনুমোদন করা হয়। সেই সঙ্গে কোম্পানির পরবর্তী এক বছরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোম্পানির শেয়ার কেনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির অংশীদারিত্ব পাওয়ার কারণে এজিএমে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।ক্ষেত্রবিশেষে কোম্পানিকে এজিএমে বিনিয়োগকারীদের কাছে জবাবদিহিও করতে হয়। আর উন্নত বিশ্বে বাজারের স্বচ্ছতা এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এজিএমে বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। নানা কারণে কিছু কিছু কোম্পানি নিজেদের দুনীতি এবং সচ্ছতা এড়িয়ে যাবার জন্য বা এজিএমে বিনিয়োগকারীদের নিকট জবাবদিহিতা এড়িয়ে নামমাত্র ডিভিডেন্ড দিয়েই নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ-সংক্রান্ত শর্ত পরিপালন করতে চায়। আর কিছু কিছু কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর এমন অনৈতিকতা থেকেই ‘এজিএম পার্টি’ তৈরি করেছে এবং জিইয়ে রেখেছে। বিশেষ করে বছরে দুবার এজিএমের সময় এলেই এ চক্রের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি বেড়ে যায়। আর সময়ের ব্যবধানে সেই কোম্পানিগুলোই এখন এজিএম পার্টির হাতে জিম্মি অর্থাৎ এজিএম পার্টি এখন নিজেদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এড়াতে আবার কখনও বাধ্য হয়েই এজিএম পার্টির খপ্পরে পা দিতে হচ্ছে কোম্পানিগুলো।

এজিএম পার্টির দৌরাত্ম্যের শিকার বেশকিছু কোম্পানির দায়িত্বশীলরা বর্তমান পুঁজিবাজারের এজিএম পার্টির কর্মকান্ড সম্পর্কে চমকপ্রদ নানান তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু কোম্পানির স্বার্থে তারা নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। একটা সময় যখন তালিকাভুক্ত কিছু কিছু দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের এড়িয়ে এজিএম সম্পন্ন করার জন্য নিজস্ব কিছু লোকের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে সেই অ্যাকাউন্টে কোম্পানির নামমাত্র শেয়ার দিয়ে বিনিয়োগকারী সাজিয়ে তাদের মাধ্যমে এজিএমে এজেন্ডাগুলো পাস করিয়ে নিত। এ প্রবণতার কারণে পুঁজিবাজার ঘিরে বর্তমানে বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি হয়েছে। এজিএম মৌসুমে এলেই চিহ্নিত কয়েকটি চক্রই এজিএম নিয়ন্ত্রণ করে। অদৃশ্য শক্তির কারণে অনেক সময় কোম্পানিগুলোও এ চক্রের হাতে যেমন জিম্মি হয় অপরদিকে অবশ্য কেউ কেউ আবার নিজেদের স্বার্থে এজিএম পার্টিকে ব্যবহার করে থাকে।
কোম্পানিগুলো আর কতদিন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতাড়িত ও বঞ্চিত করবে ?
এজিএম পার্টির কাছে জিম্মি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তুলনায় চক্রটি তুলনামূলক শক্তিশালী হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা গণমাধ্যমের সঙ্গে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চায় না। এজিএমে বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ জরুরি। কিন্তু বেশ কিছু কারণে বিনিয়োগকারীরা এজিএম বিমুখ হন, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, কোম্পানির কিছু ভাড়াকরা এজিএম পার্টির দৌরাত্ব, অর্থ্যাৎ এজিএম পার্টিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ বিনিয়োগকারী উপস্থিত হলেও কথা বলার সুযোগ থাকেনা বা পান না। আর আগে থেকেই বিনিয়োগকারীদের কোম্পানির বিরুদ্ধে কথা না বলার জন্য শতর্ক করিয়ে দেয়। তাই এজিএমে কার্যত নীরব দর্শক হয়ে থাকেন সাধারন বিনিয়োগকারীরা। আর এজিএমে হট্টগোল বা বিশৃঙ্খলার যে ঘটনা ঘটে, তার পেছনে থাকে এই সংঘবদ্ধ চক্র, এগুলো মালিকপক্ষ এবং বিনিয়োগকারী সবাই কমবেশি জানে,আবার এখানে অনেকেই আছে তাদের মুখ বিনিয়োগকারীদের কাছে অতিপরিচিত। কিন্তু এজিএম পার্টির সদস্যদের খুঁটির জোরের কারণে অনেকে কোনো কিছু বলে না ও বলতে পারেনা।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এজিএম পার্টির অপতৎপরতা সম্পর্কে অবগত আছেন, এমনই ধারণা বিনিয়োগকারী ও গণমাধ্যমকর্মীদের। কারণ এজিএমে বিশৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আগে সরজমিনে এজিএম মনিটরিং করত। কিন্তু এ চক্রের দৌরাত্ম্যের কারণে জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে নিজেদের দ্বায় এড়ানোর জন্য সরজমিনে মনিটরিং থেকে দুরে সরে এসেছে সংস্থাটি। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাজারের খুঁটিনাটি সব বিষয়ই বিএসইসির নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। তাছাড়া বর্তমানে এজিএমের ভিডিও ফুটেজ বিএসইসির কাছে পাঠানো হয়। একই ব্যক্তি প্রায় সব এজিএমে একই ধরনের বক্তব্য রাখায় বিষয়গুলো কারও নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। মজার ব্যাপার হলো, এজিএম পার্টির লোকজনকে বিনিয়োগকারীরা চেনে, অংশীজনদেরও বেশিরভাগই তাদের জানে। ব্যক্তিগত শত্রুতায় পরিণত হতে পারে আশঙ্কায় জানা থাকলেও কারও নাম উল্লেখ করে না কেউ। সবচেয়ে বড় কথা, এজিএম পার্টির সদস্যদের নাম-পরিচয় খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো নিয়ন্ত্রক সংস্থার, গণমাধ্যমকর্মীদের নয়। গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ শুধু কী ঘটছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন তুলেধরা। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেই তদন্ত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। যেখানে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ জড়িত, সেখানে উদাসীনতা দেখানো বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
সর্বোপরি দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, নীতিনির্ধারণী মহল, আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন ও বিনিয়োগকারীসহ অংশীজনদের নিজ অবস্থান থেকে এজিএম পার্টিকে প্রতিহত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়ন এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থ সমুন্নত রাখার বিকল্প নেই। প্রকৃতপক্ষে এ চক্রকে শনাক্ত করারও কিছু নেইÑসবই জানার অজানা অর্থ্যাৎ ওপেন সিক্রেট। এরা প্রকাশ্যেই চলাফেরা করছে এবং অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে নিজেদের স্বার্থের জন্য বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। সবাই আন্তরিক হলে এ চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দায়িত্বশীলদের জন্য হয়তো একটু কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমরা আশা করি, বিষয়টি সহসা সুরাহা হবে এবং বিনিয়োগকারীরাও জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাবে।