
এই উপমহাদেশে আজ থেকে প্রায় দুশ’ বছর আগে ভারতের কিছু অঙ্গরাজ্যে হিন্দুদের মধ্যে এক প্রকার ট্যাক্স বা কর প্রচলিত ছিল। করটির নাম- ‘স্তন কর’ বা ‘Breast Tax’ । এর আরেকটি নাম মুলাককারাম (Mulakkaram)। আর এরকম একটি রাজ্যের নাম ট্রাভোঙ্ক্রর, বর্তমানে সেই সেই এলাকা কেরালা রাজ্যের অধিন। সেই রাজ্যে তখন নিয়ম ছিলো ব্রাহ্মণ ব্যতিত অন্য কোনো হিন্দু নারী তার স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হিন্দু নারীরা তাদের স্তনকে এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো, বাকি হিন্দু শ্রেণীর নারীদেরকে প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো। সেই ভাবে তাদেরকে বাইরের কাজ-কর্ম বা চলাফেরা করতে হতো। বিকল্প একটা ব্যাবস্থা ছিল। যদি কোনো নারী তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইতো, তবে তাকে স্তনের সাইজের উপর নির্ভর করে ট্যাক্স বা কর দিতে হতো। যার স্তন যত বড় তাকে তত বেশি ট্যাক্স বা কর দিতে হত। এই নির্মম করকেই বলা হয় স্তনকর বা ব্রেস্ট ট্যাক্স। নিম্নশ্রেণীর গরীবদের জন্য যা ছিল “বোঝার উপর শাকের আঁটি”। উচ্চ হারের স্তনট্যাক্স দেওয়া নিম্নশ্রেণীর গরীবদের পক্ষে সম্ভব হতো না। ফলে তাদের নারীদেরকে প্রচলিত রীতি অনুসারে স্তন উন্মুক্ত রেখেই বাইরে বেরুতে হতো।
কোন অন্যায়,অবিচার দিনের পর দিন চলতে পারেনা। বড় প্রতিবাদ এলো এক দলিত নারীর কাছ থেকে। ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’র বড় অংশই যেত ত্রিবাঙ্কুরের রাজাদের কুলদেবতা পদ্মনাভমন্দিরে। দলিতদের আজীবন ঋণের নিগড়ে বেঁধে রাখার এই ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় আলাপুঝার এঝাওয়া সম্প্রদায়ের এক নারী, নাম নাঙ্গেলী,(Nangeli অর্থ সুন্দরী)। ১৮০৩ সালে এই সাহসিনী নারী রাজার ওই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার স্তনকে আবৃত করে রাখে এবং “স্তন কর” দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
স্তন ট্যাক্সের এই বর্বর রীতি বন্ধের আগে অনাবৃত অবস্থায় চলাচলকারী মহিলারা
যখন গ্রামের ট্যাক্স কালেক্টর তার বাড়ীতে আসে তার কাছে স্তনকর চাইতে, তখন নাঙ্গেলী তাকে কিছুক্ষণ বসতে বলে সে অন্যঘরে যেয়ে একটা কলাপাতা ঘরের মেঝেতে বিছিয়ে মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে প্রার্থনা করতে বসে। প্রার্থনার কিছুক্ষণ পরে নাঙ্গেলী নিজের স্তন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ওই কলাপাতায় মুড়ে ট্যাক্স কালেক্টরের হাতে দেয়। কাটা স্তন দেখে ট্যাক্স কালেক্টর চমকে ওঠে। ট্যাক্সের বদলে কাটা স্তন!
স্তন কাটার কিছুক্ষণ পরেই নাঙ্গেলীর মৃত্যু হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। নাঙ্গেলীর স্বামী চিরুকান্দনস্ত্রীর মৃত্যুশোক সইতে পারে না, সেও নাঙ্গেলীর চিতার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্বজাতীয়দের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা আন্দোলনে নামে এবং আন্দোলন এমন দানা বেধে ওঠে যে, এই ঘটনার পর থেকেই স্তন কর বন্ধ হয়ে যায়। ট্রাভোঙ্ক্রর রাজ্যে স্তন কর বন্ধ হলেও দক্ষিণ ভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য অনেকদিন সংগ্রাম করতে হয়। হিন্দু নারীরা যখন তাদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার দাবি করে, তখন হিন্দু পুরোহিতরা স্পষ্ট করে বলে- নীচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম-বিরোধী। বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি বড় দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। এই দাঙ্গা “কাপড়ের দাঙ্গা” বা মারু মারাক্কালসমরম নামে অভিহিত করা হয়।
এখন আর এই অন্যায় আইন বা ধর্মীয় রীতি নেই। কিন্ত এই নিপীড়নমুলক আইন বন্ধের সুচনা করেছিল এক সাধারণ নারী তার নিজের স্তন কর্ত্তন তথা জীবন বিসর্জন দিয়ে।
নাঙ্গেলী যেখানে বসবাস করত, পরবর্তীতে নাঙ্গেলীর স্মরণে সেইস্থানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “মুলাচিপারামবু”, যার অর্থ “The land of breasted women”.
নাঙ্গেলীরা মরে না, ফিরে আসে বারবার, ভিন্ন ফর্মে। হয়তো এবার মুসকান রুপে।
তথ্য : সংগ্রহিত