
খোন্দকার জিল্লুর রহমান :
দেয়ালের পলেস্তারা (আস্তরন) একটু একটু করে ঝরে পড়তে শুরু করেছে অনেক আগ থেকেই, শেওলা না ধরলেও নিষ্ঠুরতার চার-দেয়ালটা আচরনের নিষ্ক্রিয়তায় হাবুডুবু খেয়ে চলছে জীবন। সহধর্মিনী (স্ত্রী) মারা যাবার পর আমার একাকীত্ব একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমাকে নাযেহাল করলেও নিষ্ক্রিয়তার অমানবিক আচরনেও জীবন থেকে পালিয়ে যাই নি। এর-ই মাঝে নিঃসঙ্গতার গল্পটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে জন্ম নেওয়া আমার দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে আমার স্বপ্নের জালে আবর্তিত জীবন। সৃষ্টিকর্তা একাই আমার দুই মেয়েকে অনেক বড় করে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। পড়াশোনা করিয়েছি, একজনকে বিয়ে দিয়েছি। স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা না হলেও সামাজিক অবস্থান রাব্বুল আলামিন অনেকটাই আমাকে করে দিয়েছেন। ভেবেছিলাম, বৃদ্ধ বয়সে অন্তত কেউ পাশে থাকবে। কিন্তু বাস্তবটা যে এতটা নিষ্ঠুর তা কল্পনাও করি নি।
একটা নির্দিষ্ট লক্ষমাত্রার লালিত স্বপ্ন যাকে নিয়ে পূরণ করার দ্বারপ্রান্তে উপনীত ঠিক সে সময় নিজ হাতের উপর একজন সবচেয়ে নিকটতম প্রিয় মানুষের চিরবিদায় নেয়ার যে দৃশ্য কত হৃদয় বিদারক তা আমার চেয়ে ভাল বুঝার অবস্থা কারো আছে কিনা জানি না। বিচ্ছেদের যন্ত্রনা যে কত, যার চলে যায় সেই বুঝতে পারে।

আমার সহধর্মিনীর সকল আশার প্রদীপ জ্বেলে আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে চলে যাওয়া আমি সেটা কতটুকু সঠিক ভাবে পালন করতে পেরেছি বা পারব আমার জানা নেই। তবুও চেষ্টা করে মেয়েদেরকে শিক্ষার সর্বোচ্ছ পর্যায়ে অগ্রসর করে দিতে পেরেছি বাকি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। অনেক সময় তার শরীর খারাপ দেখলে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করে বলতাম আল্লাহপাক যেন তাকে ভাল রেখে আমাকে নিয়ে যায়, কিন্তু সে মানতে পারত না, সাথে সাথে বলত না তুমি নয় আল্লাহপাক যেন আমাকে নিয়ে যায় কারণ তুমি মরে গেলে মেয়েদের নিয়ে কোথায় দাঁড়াব আমার কোন তো ইনকাম নাই আর আমি মরে গেলে তুমি মেয়েদের সবকিছু চালিয়ে রাখতে পারবে, আল্লাহ যেন তোমাকে সুস্থ রাখে। সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এখন সবসময় নিজের সুখ আর সুস্থতার কথা চিন্তা না করে চেষ্টা করি মেয়েদের ভাল রাখতে। আমার বেঁচে থাকাটা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে শুধু ভাবছি সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে না নিয়ে আমার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে গেল?
নাতি-নাতনি নিয়ে বড়মেয়ে কিছুটা হলেও ব্যস্ত হয়ে যায় নিজেদের সংসারে, চাকরিতে কিংবা পেশাগত কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত না থাকলেও সংসার জীবনের এক সুন্দর অবস্থান তাকে দেবির আসনে বসিয়ে রেখেছে যা গর্ব করার মত। অত্যধিক পরিশালিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছোটমেয়ে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়েও বাবার কার্যক্রমের উপর এক আপসহীন স্বপ্নের জাল বুনন করে রেখেছে স্বয়নে স্বপনে বাবার অস্তিত্বের সাথে। আমি এবং আমার স্ত্রী অর্থ্যাৎ আমরা সবসময় বলতাম ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই মা-বাবার দিকে বেশি খেয়াল রাখে। দুই মেয়ের প্রতি দুর্বলতা আমার সব সময়ই ছিল, আমি জানি সব স্বামীর নিকট তার স্ত্রী রাজরানী হতে না পারলেও সব মেয়েরা তার বাবার নিকট রাজকন্যা। আর আমি কখনোই চাই না, আমার মেয়েদের নামে কেউ কিছু বলুক, হোক সে ঘরের বাইরের বা ঘরের। আমি জানি, এই বৃদ্ধ বয়সে বাবার অস্তিত্বই অনেক বড় আমার মেয়েদের কাছে।
আজ ৩০ অক্টোবর ২০২৫ বৃহস্পতিবার, দীর্ঘ ৮ বছর ৩ মাস ৫ দিন ১৫ ঘন্টা সময় পেরিয়ে এসে আমার আকাশ থমকে যায়…। আজ তোমার না থাকার বছর গুনে গুনে ক্লান্তির নির্মম বাস্তবতায় এসে আমার দেবির শুন্য আসনে অন্য একজনকে স্থলাভিষিক্ত করার মুহূর্ত। কারণ তোমায় ছাড়া আমার সময় থেমে গেছে অনেক আগেই। তোমার শরীরের গন্ধ, তোমার ছায়াপথে হাটা, তোমার কথা, তোমার ছোঁয়া, পরস্পরের আলিঙ্গন সব আজও মনের কোনে কোনে অষ্ট প্রহর কোথাও জেগে আছো নিঃশব্দে আমার প্রতিটা রক্ত বিন্দুর মাঝে সবসময়।

কিন্তু আমি…, প্রতিদিন কাজের শেষে সন্ধ্যায় বা রাত্রিতে এসে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি, হয়তো আজ না হয় কাল কেউ আসবে, দরজা খুলে দিতে। দিন কেটে যেতো, মাস কেটে যেতো, দরজা খুলত না। বাড়ির যেন প্রতিটি ঘরে নিঃসঙ্গতা হাঁটাহাঁটি করত। কখনো মেয়েরা এসে দরজা খুলে দেয়, আবার কখনো নিজেই চাবি দিয়ে তালাখুলে ঘরে ঢুকতে হয়। জীবন কি শুধুই যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার নাম হয়ে দাঁড়ায়? কেন যেন মনে হয় আমি নিজের জন্য নিজে ভাল থাকতে পারি না।
পরিচয় হলো এমন সময় এক মহিলার সঙ্গে। বয়সে অনেক তফাত না হলেও গ্রহনযোগ্যতায়, জীবনের লড়াই করছে একা একা, সাথে এক সন্তান নিয়ে প্রতিক্ষায়। মহিলার প্রতি প্রথমে করুণা কাজ করলেও ধীরে ধীরে বুঝলাম, তার হাসিতে আছে বেঁচে থাকার শক্তি যেন কোথায় কাজ করতেছে। তাঁর নির্ভরতার শক্তি প্রবলভাবে আমাকে তাঁর মনে প্রতিস্থাপন করে নিয়েছে। আমি বুঝলাম, নিজের জন্যও একটা আশ্রয় প্রয়োজন। একজন মানুষ দরকার, যে শুধু আমাকে “আপনি কেমন আছেন” বলে জিজ্ঞেস করবে। মানুষের জীবনে চাওয়া পাওয়ার কি-ই-বা থাকে!! সমাজ, ভাই-বোন মেয়েদের কথা ভেবেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে সিদ্ধান্ত নিযে বিয়ে করি। এই সিদ্ধান্ত আমার ভাই-বোনদের কেউই সাদরে গ্রহণ করেনি। আমার নিকট ব্যপারটা এমনই মনে হলো যে, পরিবারের আপন লোকজন আসলে কিসের জন্য? যদি পরিবারে লোকজন পরিবারের আপন লোকেদের সুবিধা-অসুবিধা বা তাৎক্ষনিক মুহূর্তে উপস্থিত না থাকে, যদি পারিবারিক কাজে পরিবারের সদস্যদের হাতে পায়ে ধরে উপস্থিত করাতে হয়, ঠিক তখনই প্রশ্ন জাগে, আমরা আসলে কতটুকু সভ্য পরিবার? এটা হয়তো আমাদের সমাজের সকল পরিবারের চিত্র কি না? তা আমার হয়ত জানা নেই।
আমার দুই মেয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে আমার সর্বশক্তি, তারা বলল, “বয়সে এসে এক সময় আমরা যখন বাবার কাছে থাকব না বা থাকতে পারব না তখন বাবার একাকীত্ব, আমাদের নিকট পীড়াদায়ক হবে, আর সবার নিকট হতে এসব আচরন ভালো দেখায় না।” বাবার পরিবারের কেউতো ভাবল না, কত রাত কত সময় এই মানুষটা একা একা কেঁদেছে। জানি বিয়ের পর জীবন বদলে যাবে। সকালে মুখের হাসি নিয়ে ঘুম ভাঙবে, কারো সাথে নাস্তা খেতে বসবে, কারো হাসিতে আবার বাড়িটা সরগরম হয়ে উঠবে। অবহেলিত হৃদয়ে আবার ভালোবাসার আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়বে।, “আমরা সবাই চলে গেলে, এই সে-ই দেখবে বাবাকে।”
মানুষের বয়স বাড়ে, কিন্তু ভালোবাসার অধিকার কখনও কমে যায় না এটা সত্য। কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বুঝলাম আরো একটি সত্য, নিজের ভালো থাকার জন্য নিজেকেই আগলে রাখতে হবে। পারিবারিক সহযোগিতা সহমর্মিতা কখনো কখনো বিরুপ প্রতিযোগিতা এবং প্রতিকুলে কাজ করে, অনুকুলে নয়। আর আমার বেঁছে থাকার আকাঙ্খা আমার মাঝেই স্বার্থক হয়ে থাকুক। সুখী হওয়ার অধিকার সবার আছে। পরিবার মানেই রক্তের সম্পর্ক নয়। পরিবার মানে, যারা আপনাকে একা ফেলে যায় না।
আজ আমার গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে, “আমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করেছি। কারণ “বেঁচে থাকা” আর “বাঁচা” দুইটি সম্পুর্ণ আলাদা বিষয়।




















