“পি আর পদ্ধতি এবং এর প্রয়োগিক সুবিধা-অসুবিধা”

খোন্দকার জিল্লুর রহমান :
”Democracy, Bureaucracy, Republic, socialism are the Talk about Political words of the Day.” ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার এক শিক্ষক এই সেন্টেন্সটা মুখস্থ করিয়েছিলেন। এই সেন্টেন্সের অর্থটা তখন ভাল না বুঝলেও গত বেশকিছুদিন থেকে এর অনুধাবন মোটামোটি ভালো করেই বুঝতে বাকি নাই আমাদের দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের অদুরদর্শিতার কারনে। বর্তমান সময়ে টিভি, সোস্যাল মিডিয়া, টকশো এবং মানুষের মুখেমুখে যাই বলি না কেন, সকল ক্ষেত্রে আলোচনার বিষয় বস্তু একই, “পিআর (PR) সিস্টেম অর্থাৎ অংশিদারীত্বের নির্বাচন (Percentage Ratio Election)”
অংশিদারীত্বের নির্বাচন অর্থ্যাৎ পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কি ও কেন?
সারাবিশ্বে “গনতন্ত্র” এখন হুমকির মুখে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। যার কারনে সভ্যতা, জননিরাপত্তা, ক্ষমতা, আইন সৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিক সুসৃঙ্খলাত্বের জন্য মানুষ দিনদিন আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হতে যাচ্ছে, পিআর পদ্ধতি তারই এক সংস্করন। এর প্রায়োগিক সুবিধা-অসুবিধা গ্রহনযোগ্যতার উপর নির্ভর করবে।
বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি নতুন হলেও বিশ্বের গণতান্ত্রিক ১৭৬টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে পি আর পদ্ধতি চালু আছে। অতি মোড়লিপনা দু-একটি রাষ্ট্রে যেমন ভারত, আমেরিকার মতো কিছু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই পদ্ধতি সমাদ্রিত নয়। আমেরিকা স্বাধীনতা পেয়েছে ১৭৭৬ সালে আর ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট, (যদিও ১৪ এবং ১৫ আগষ্ট নিয়ে বিতর্কিত)। আলোচনা সমালোচনার বেড়াজালে গণতান্ত্রিক ধ্বজাধারি দেশগুলোর মোড়লিপনা কেউ পছন্দ না করলেও ভারতের আশেপাশে তেমন কোনো ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নেই তাদের উপর প্রভাব খাটানোর মত, অপরদিকে বিশ্ব মোড়ল খ্যাত আমেরিকাতো অন্যান্য সব শক্তিশালি দেশগুলোতে তাদের তাঁবেদার সরকার বসিয়ে পরোক্ষভাবে শাসন ও শোষণ করে চলেছে। আমরা তথা এই ভুখন্ড পুর্বপাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতৃত্বে স্বাধীকার আদায়ে এ ভুখন্ডের মানুষ পুষে উঠলে প্রথমত আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট। কিন্তু একটা সদ্য স্বাধীন রাষ্টের অবকাঠামো মজবুত এবং মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন না করে কিছু স্বার্থন্বেষী লোক ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোটেল রোজগার্ডেনে বসে আরেকটি নতুন দল ঘোষনা করে, যার নাম দেওয়া হয় আওয়ামি মুসলিম লীগ, পরে মুসলিম জাতিস্বত্বার উপর চরম কুঠারাঘাত করে একটা ক্ষমতালোভী ফ্যাশিশক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য আওয়ামি মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম বাদ দিয়ে “আওয়ামি লীগ” গঠন করে। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে বলে এ দেশের নিরীহ সহজ-সরল মানুষদেরকে প্রতারনার ফাঁদে ফেলে ক্ষমতা লোভী নির্দিষ্ট ব্যক্তি জগন্নাথ হলে সংসদ চলাকালীন সময়ে স্পিকার শাহেদ আলি হত্যাসহ শেখ মজিবুর রহমান বিভিন্ন অপকর্মের নায়কে পরিনত করে নিজেকে। এ দেশের শিক্ষিত এবং সুশীল সমাজ যখন বুঝতে পারে পুর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান সীমানা দুরত্বে প্রায় ১,৫০০ (দেড়হাজার) মাইল, এত গ্যাপে প্রশাসনিক জটিলতা তেমন একটা না দেখা গেলেও একক ব্যক্তিবিশেষ ভুল বুঝিয়ে নিজের আধিপত্ব বিস্তার এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য মানুষকে উত্তাল করে তোলে প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়ার জন্য। যার ফলে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ পুর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাদে এবং এতে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রান হারায়, সেসাথে দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা আমাদের হাতে আসে। কারন, একটা দেশ আসলে দুইবার স্বাধীন হয় না, যেহেতু আমাদের সংবিধানের প্রথম ক্লজই হলো, “চিহ্নিত পুর্ব পাকিস্তানের সীমানাই হলো আজকের বাংলাদেশের সীমানা, এখানে উল্লেখ না করলেই নয় যে, দীর্ঘ ৪১ বছর মুসলিম লীগের ত্যাগের বিনিময়ে পুর্ব পাকিস্তান ভুখন্ড তৈরি হয়েছে, এই পুর্ব পাকিস্তান তৈরি না হলে আজকের বাংলাদেশ হত না। বর্তমানে দেশের ১৮ কোটি সচেতন নাগরিকের দাবি, প্রায় ৫৪ হাজার বর্গমাইলের ছোট একটা দেশের স্বাধীন প্রশাসনের জন্য কেন এত লোকের প্রান দিতে হয়েছিল, এর জন্য দায়ী শেখ মুজিবুর রহমান এর মরনোত্তর বিচার হওয়া উচিত এবং বিচার চাই।
দেশের কিছু নগন্য সংখ্যক সুশীল নামধারি ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্লোভ ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়ীত করলেও ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একমাত্র দাবিদার দাবি করে ক্ষমতায় বসেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় বসার মাত্র তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতার মূল চেতনাকে ধূলিসাৎ করে অধিকাংশ জনগণের মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে একতরফা ভাবে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার ফলে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল। সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসলেন। জনগণও আশায় বুক বাঁধলেন এবং তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন বিএনপি নামক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। দেশও ভালো চলছিল কিন্তু পার্শ্ববর্তী শকুনদের পছন্দ হলো না তাই তাকেও জীবন দিতে হলো। তারপরের ইতিহাস সকালের জানা। এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসলেন ঠিকই কিন্তু দেশে দীর্ঘস্থায়ী গনতন্ত্র দিতে না পারলেও ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনকে হাত করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে গনতন্ত্রের পুর্ণ কবর রচনা করে আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য ফ্যাসিবাদী স্বৈর শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। দেশের সাধারণ জনগনের চাওয়া-পাওয়া খুবই সামান্য। কিন্তু ক্ষমতা লিপ্সু দলীয় এসব নেতারা আজীবন ক্ষমতায় থাকার লোভে একটি অশিক্ষিত অসভ্য বর্বর ও লুটেরা গোষ্ঠী তৈরী করে সাধারণ জনগনকে শোষণ করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন।
পি আর পদ্ধতির নির্বাচন কি এবং পি আর পদ্ধতি অর্থ্যাৎ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন মানে সাধারণ জনগনের ভোটে যথাসম্ভব বেশী সংখ্যক দলের বাছাইকৃত যোগ্য সাংসদ কর্তৃক পরিচালিত সরকার ব্যবস্থা। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত বা স্বল্প উন্নত দেশে নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতির লক্ষ্যকে সামনে রেখে অধিক সংখ্যক দলকে তালিকাভূক্ত করা, অর্থ্যাৎ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যাতে সর্বসাধারণ দলীয়ভাবে প্রতিক বা মার্কা দেখে ভোট দিয়ে থাকে। পিআর পদ্ধতির নির্বাচন মানে যে দল নির্বাচনে অংশ নেওয়া মোট ভোটারের যত শতাংশ ভোট পাবে সে অনুপাতিক হারে সংসদীয় আসন পাবে, এটাই হলো পি আর পদ্ধতির নির্বাচন। উদহরন স্বরুপ দেশে ১কোটি ভোটার থাকে এবং কোনো দলীয় প্রতিকে ১ লক্ষ ভোট পায়, তবে সে দল ২০০ বা ৩০০ অথবা ৫০০ আসন বিশিষ্ট সংসদে যথাক্রমে ২টি, ৩টি,বা ৫টি আসনের প্রতিনিধিত্ব পাবে।
উন্নত বিশ্বের ৯১টিরও বেশি দেশে পিআর পদ্ধতি চালু থাকলেও ভারত ও আমেরিকার মত বৃহত গনতান্ত্রিক দেশে এ পদ্ধতি নাই, অবশ্য এসব দেশে গনতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার যেমন মুল্যায়ন করে অপরদিকে তাদের আশেপাশের ছোট দেশগুলোর উপর নিজেদের প্রভাব এবং আগ্রাসন চালিয়ে যায় বেশি। এরা শুধু আধিপত্ববাদ বিস্তার করে নিতে জানে, দিতে জানে না। যেমন ভারত আমাদের দেশে(বাংলাদেশ) আজীবন তাদের তাবেদার সরকার বসিয়ে নিজেদের নিরব আগ্রাসন ও প্রভাব খাটিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করে নিয়েছে, যা সম্প্রতি সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দলনের মুখে ক্ষমতা এবং পদ পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক হাসিনার প্রকাশ্য “ভারতকে আমরা যা দিয়েছি, ভারত সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না” বলার মাধ্যমে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় আগ্রাসন ও প্রভাবমুক্ত থাকলেও দেশের প্রভাবশালী ক্ষমতালিপ্সু একটি রাজনৈতিক দল দেশের ১৮ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার দিকে না তাকিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মরিয়া হয়ে উঠেছে, যা দেশের গনতন্ত্র এবং মানুষের অধিকারের প্রতি হুমকি স্বরুপ। পিআর পদ্ধতি গনতন্ত্রের সুফল বাস্তবায়ন বলে গন্য হলেও আমাদের দেশের স্বল্পশিক্ষিত জাতি গোষ্ঠির দল এবং প্রতিক নির্ভর কিছুকিছু অদূরদর্শী অর্থলোভী নেতাদের অনৈতিক প্রভাবের আগ্রাসন, যা একটা উন্নয়নমুখী জাতির উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে গনতন্ত্রকে পদদলিত করে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। আমাদের অগ্রযাত্রা কি আবারো সেই পথে?

কেনো পি আর পদ্ধতি বা এর সুবিধা-অসুবিধাঃ
প্রথমতঃ দেশে প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে কোনো সংসদীয় এলাকায় যে দলের পার্থী সর্বোচ্ছ সংখ্যক ভোট পাবেন তিনি সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট নিজস্ব এলাকার মোট ভোটের ২৫% থেকে ৪০% ভোট পেলেই তিনি সংসদ মনোনীত হবার সুযোগ থাকে, বাকি ৬০% থেকে ৭৫% ভোটার সেই মনোনিত প্রার্থীকে অপছন্দ করলেও তাঁর সব অনৈতিক কাজ এবং কথা সকলে মানতে বাধ্য। একই ভাবে সারা দেশে কোনো দলের প্রাপ্ত ভোট ৩০% থেকে ৪০% হলেও উক্ত দল ক্ষমতায় যেতে পারে। বাকি ৬০% থেকে ৭০% ভোটারের যৌক্তিক এবং ন্যায়সংগত কাজের মুল্যায়ন হয় না। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে কয়টি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে কোনো দলই এককভাবে ৪০% এর বেশী ভোট পায়নি কিন্তু সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পি আর পদ্ধতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে দল বা যে মার্কায় মোট ভোটারের যত পার্সেন্ট ভোট পাবে সে অনুযায়ী সংসদ পাবেন এবং ৩০০ আসন বিশিষ্ট সংসদে কমপক্ষে ১৫১ আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে হয় তাতে যে কয়টি দলের সমর্থন প্রয়োজন হউক না কেন?। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোটার প্রায় ১২ কোটি,৭৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯৮৩ জন। তাদের মধ্যে বর্তমান পদ্ধতিতে মাত্র ৩ কোটি থেকে ৪ কোটি ভোট পেয়েই একটি দল সরকার গঠন করার ক্ষেত্র তৈরী হওয়ার সুযোগ আছে, যার ফলে অবশিষ্ট ৮ কোটি সচেতন ভোটারকে শাসন ও শোষণ করার সুযোগ থাকে। এতেকরে সকলে নির্বাচিত দলের নির্দেশ মানতে বাধ্য, যার কারনে যোগ্য লোকের মুল্যায়ন হয় না, দেশে দূর্নীতি ও সামাজিক অবক্ষয় বাড়ে। অনেকের মন্তব্য, যে সকল দলের দুই/একজন এমপি হওয়ার ক্ষমতা নেই তারাই পি আর পদ্ধতির নির্বাচন চায়। প্রকৃতপক্ষে ৫/১০টি দল মিলে যদি সরকার গঠন করে, সেখানে কোনো দলীয় বা সংসদীয় কোন সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ একেবারেই কম থাকে উপরন্ত এক দল অন্য দলের সংসদের প্রতি কঠোর নজরদারি রাখার কারনে শুদ্ধাচার তৈরি হয় এবং জবাবদিহিতার মাঝে লুটপাট, অন্যায়-অবিচার, চামচামি ও লেজুড়বিত্তির সংস্কৃতি দুর হয়।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশে নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ার কারনে দলে যোগ্য প্রার্থী কম থাকলেও প্রতিটি দলই পূর্ণ ৩০০ আসনে অনৈতিকভাবে আর্থিক বিনিময়ে প্রার্থী দিয়ে থাকে, তাই উপযুক্ত ও শিক্ষিত লোকের অভাবে অশিক্ষিত, লোভী, সন্ত্রাসী, দু-চরিত্র, লোকদের প্রার্থী হিসাবে স্থান পায়। আবার এই অযোগ্যদের মধ্যে অনেকেই শুধু মাত্র দলীয় প্রতিকের কারনে সংসদ নির্বাচিত হয়ে সবধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে দুই একজন ব্যতিত সবাই। ৭১ এর পর থেকে ৫৪ বছর এমন চিত্রই দেখা গেছে। কখনো সুবিধাভোগীদের হাতে আবার কখনো ব্যবসায়ীদের ব্যবসার হাতিয়ার হিসাবে। আমরা কখনো আমাদের এই এশিয়ান ভোল্টের উন্নত ছোট ছোট দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের দিকে একটু খেয়াল করে নিজেদের অবস্থান চিন্তা করি না।
তৃতীয়তঃ আমাদের দেশের প্রথাগত নির্বচনে প্রথমদিকের জনপ্রিয় অধিকংশ দল প্রার্থী ঘোষণা করে এমন লোকজনদেরকে যারা নির্বাচনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অর্থ্যাৎ শত শত কোটি টাকা খরচ করে জয় নিশ্চিত করতে পারবে। প্রথাগত নিয়মে না থেকে পরক্ষভাবে নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী দেশের সংসদ প্রার্থীদের অনেকেই না কি ১০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করেন এমপি হওয়ার জন্য। কারন, দলীয় উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদেরও অনৈতিকতার নিকট এটা একটা লাভজনক ব্যবসায় পরিনত হয়েছে। যে জন্য আমাদের রাজনীতি জনসেবা এবং রাষ্ট্র উন্নয়নের না হয়ে একটা লাভজনক ব্যবসায় পরিনত হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে গত সংসদ নির্বাচনেও ৩০০ নির্বাচিত সাংসদের মধ্যে ১৯৮ জন ছিলেন ব্যবসায়ী (প্রতি সংসদ নির্বাচনের পর বড়বড় ব্যবসায়ীরা এই দলে যুক্ত ছিলেন ও হচ্ছেন)। সেই সাথে বটতলার উকিল, খেলোয়াড়, গায়ক-গায়িকা ও নায়ক-নায়িকা মিলে ৫৩ জন তাদেরও নিজস্ব প্রফেশন বাদ দিয়ে এমপি হওয়ার খায়েস পুরন করেছেন। যে কারনে চরিত্রহীন গায়িকা মমতাজ এবং বাংলায় সাধারন লিখা না পড়তে পারা কাজের বুয়াকে পর্যন্ত সংসদে স্থান করে দিয়েছে। বাকিদের মধ্যে গুটিকয়েক খন্ডকালিন রাজনীতির সাথে জড়িত। এতে দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে কিছু কিছু দল দলীয় প্রার্থী নির্বাচনের সময় দলের তহবিলে কত টাকা চাঁদা বা অনুদান দিবে এবং নির্বাচনে কত টাকা খরচ করে সর্বোপরি আসনটি আয়ত্তে আনতে পারবে তার উপর ভিত্তি করে প্রার্থীতা অনুমোদন করে থাকে। ফলে এসব দলীয় সংসদের নিকট হতে রাষ্ট্রীয় নীতি বা কোন আদর্শ উন্নয়ন কিছুই পাওয়া যায় নাই লুটপাট আর অর্থ পাচার ব্যতিত।
চতুর্থতঃ বর্তমান প্রথাগত নিয়মে নির্বাচনে দলীয় সংসদ উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের পদগুলোতে যাতে উক্ত দলের ভিতরে তারই পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে তার সর্বধরনের চেষ্টা করবে যাতে তিন নেতা মিলে কাজ না করে সকল ধরনের উন্নয়নের অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করে ভোগ করতে পারে এবং দলীয় প্রভাবের কারণে লোকাল প্রশাসনও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না, গত ৫৪ বছরের চিত্র তাই প্রতিফলিত। কিন্তু পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হলে ভোটারেরা গোপনে সঠিক ও সৎ প্রার্থীকে বেছে নেয়ার মাধ্যমে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোটারগন দলীয় প্রতীকবিহীনভাবে যোগ্য প্রার্থীযাচাই করে নিতে পারবে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই স্থানীয় উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা, আর সংসদেরা রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা নির্ধারনের মূল ভূমিকা পালন করেন। সেখানে উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ টাকা ভাগ-বাটোয়ারার সুযোগ তেমন একটা থাকে না।
পঞ্চমতঃ পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা কাকে দেখে ভোট দিবে বা কি দেখে ভোট দেবে? পিআর পদ্ধতির মুল বিষয় হলো, বাংলাদেশের সকল নিবনন্ধিত দলেরই আলাদা আলাদা মার্কা আছে, ভোটাররাও ঐসব মার্কা দেখেই ভোট দেয়, যার কারনে প্রত্যেকটা সংসদীয় সীমানা অনুযায়ী বড়বড় দলগুলি নিজস্ব আদলে দলীয় যেসব প্রার্থী নির্ধারন করে, এসব প্রার্থীদের বেশির ভাগই অর্থের বিনিময়ে দলীয় নমিনেশন নিয়ে ক্যাডার বাহীনি দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্র দখলের মধ্যদিয়ে জয় পেতে চায়। আর এতেকরে ক্যাডার বাহীনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব প্রার্থীদের জিতিয়ে দেয়ার মাধ্যমে উদ্দেশ্যমুলকভাবে পরবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দূর্নীতি-লুটপাট, চাঁদাবাজি করা ও দখলদারি চামচামির মাধ্যমে বিনা পরিশ্রমে নিজের ভাগ্য পাল্টানোর কাজে তাকে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলে প্রার্থীর পদ হারানোসহ জবাব দিহিতার ব্যবস্থা থাকে বিধায় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকে। ষষ্ঠতঃ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে জনস্বচেতনতার কারনে ভোটারগন দলীয় যথপোযুক্ত প্রার্থী না পেলে অন্য দলের উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত করে নিতে পারবে। যে কারনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে দলের নীতি নির্ধারকগন উপযুক্ত প্রার্থী যাচাই-বাচাই করে ঠিক করবে। দল যদি অর্থের বিনিময়ে অনুপযুক্ত প্রার্থীকে নমিনেশন দেয় সেক্ষেত্রে ভোটারেরাই উপযুক্ত প্রার্থীকে ভোট দিবে সে যে কোনো দলের হোক না কেন জনপ্রতিনিধি জনস্বাথে কাজ করতে বাধ্য হবেন।

সপ্তমঃ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে দলগুলোর মোটামুটি কিছুটা হলেও জন সমর্থন আছে তাঁদের প্রার্থীদের মধ্যে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে যে কয়টি আসন পাবে সে কয়জন উপযুক্ত সংসদকে সাংসদে পাঠাবে। যেমন ধরা যাক কোনো দলের ১০০ জন প্রার্থী রয়েছে অথচ সংখ্যানুপাতে মাত্র ১০ টি আসন পেয়েছে সে ক্ষেত্রে ঐদল ১০০ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে ধারাবাহিকভাবে উপযুক্ত ১০ জনকে সংসদে পাঠাবে। এই পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যদের দূর্নীতিমুক্ত উন্নত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তৈরি, সকলপ্রকার আইনি অবকাঠামো তৈয়ার ও বাস্তবায়ন করা সহজ হয়।
অষ্টমঃ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হলে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় যাওয়ার পুর্বেই রাষ্ট্রের সার্ভিক উন্নয়নে কি কি ধরনের উন্নয়ন পদক্ষেপ নিবে তা নির্বাচনের বেশকমাস আগেই লিখিত আকারে ভোটারদের মাঝে প্রচার-প্রচারনা চালাবে। তাতে করে দলের নীতিমালা ভোটারদের পছন্দ অপছন্দের দিকে অর্থ্যাৎ সাধারন পাবলিক সেন্টিমেন্টের দিকে নজর রেখে দলীয় মার্কায় ভোট দিয়ে প্রার্থী জয়যুক্ত করাতে চেষ্টা করবে। অপরদিকে ইউনিয়ন, জেলা-উপজেলার চেয়ারম্যানগন নির্দলীয় প্রার্থী হওয়ায় সাধারণ ভোটারেরা যোগ্যতা দেখে পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে। এই আইনি কাঠামোতে দেশের সর্বধরনে উন্নয়নে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ দলীয় সাংসদদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে নিজস্ব এলাকার উন্নয়ন এবং পরবর্তীতে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার আশায় কাজ করবে।
নবমঃ পিআর পদ্ধতিতে নির্বান ব্যবস্থা চালু হলে সমাজে বিভাজন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কেহকেহ মনে করলেও এর সম্ভাবনা একেবারে না থাকাটাই স্বাভাবিক। অর্থ্যাৎ পিআর পদ্ধতিতে বিভাজন থাকবে না। বর্তমান পদ্দতিতে একই আসনে ১০/১২ দলের ১০/১২ জন বা তারও বেশি প্রার্থী প্রতিযোগীতা করায় এক প্রার্থী অপর প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার ও কুৎশা রটাতে থাকে, এতে করে প্রার্থীদের মধ্যে থেকে শুরুকরে এলাকার সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও বিভাজন এবং সহিংসতা তৈরি হয়, যার কারনে এলাকায় সাধারন জনগন নিজস্ব প্রার্থীর পক্ষে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
দশমঃ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হলে যে সংসদিয় আসনে যত বেশি প্রার্থী হোক না কেন এতে সমাজে কোন সহিংসতা বা বিভাজন থাকবে না, সকল ভোটারের প্রদানকৃত ভোটের কার্যকরি মূল্যায়ন হবে।